ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

পাহাড়, বন কিছুই থাকছে না

রোহিঙ্গাদের জন্য শিবির স্থাপন, উখিয়ায় ১৮শ ৫০ একর বন বাগান উজাড়, কাটা হয়েছে ১৮ লক্ষ ৫০ হাজার গাছ

উখিয়া প্রতিনিধি ::

উখিয়ায় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবির স্থাপন করতে গিয়ে দিনের পর দিন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে স্থানীয় দরিদ্র লোকজনের বসতি স্থল, প্রাণী জীব বৈচিত্র্যের আবাসস্থল, কাটা হয়েছে লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ, বিলীন করা হচ্ছে একের পর এক পাহাড়, টিলা ভূমি। রোহিঙ্গাদের সেবার নামে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিওগুলো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় স্থল ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে বরাদ্দের দ্বিগুনের বেশি রিজার্ভ বনাঞ্চল জবর দখল অব্যাহত রেখেছে। বন বিভাগ ক্ষোভ প্রকাশ করলেও অসহায়ের মত নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

সরকারের নির্বাহী আদেশে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় উখিয়া সদর, উখিয়র ঘাট বনবিটের আওতাধীন কুতুপালং ও বালুখালী রক্ষিত বনাঞ্চলে প্রায় তিন হাজার একর বন ভূমি বরাদ্দ প্রদান করে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় স্থল গড়ে তুলতে। এসব বন ভূমির প্রায় সব টুকু পাহাড় ও টিলা শ্রেণীর। এসব রক্ষিত বন ভূমিতে বিভিন্ন সময় গড়ে তোলা হয় স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী বনায়ন। এসব বনায়নের অধিকাংশ অংশীদারিত্ব মূলক সামাজিক বনায়ন। এতে উপকারভোগী রয়েছে এক হাজার জনের বেশি। তাদের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। এছাড়াও এসব বনাঞ্চলের উপর রয়েছে স্থানীয় ভূমিহীনদের কয়েকশত ঘরবাড়ি। রোহিঙ্গার কারণে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বনায়নের অন্তত ১৮শ ৫০ একর বনায়ন সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। এসব বায়নের অর্ধেকের বেশি কাটার সময় হয়েছিল বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী অংশীদার সদস্যদের মাঝে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ও হতাশা বিরাজ করছে।

উল্লেখিত বনাঞ্চলে উদ্বাস্তু আশ্রয় শিবির হওয়ায় যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী স্থানীয় দরিদ্র ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠি পড়েছে চরম বিপাকে। উদ্বাস্তুদের সেবায় নিয়োজিত জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা, এনজিও ও আইএনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের লেলিয়ে দিয়ে তাদের বসত ভিটা জবর দখল করে নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন, দরিদ্র পরিবার গুলো বন বিভাগের জমি হওয়ায় কোথাও কোন সু–বিচার পাচ্ছে না বলে পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী ও স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। এ ছাড়াও কথিত সেবা সংস্থাগুলো সরকারের নির্ধারিত বরাদ্দকৃত ভূমির সীমানা না মেনে নিজেদের ইচ্ছেমত বন বিভাগের সংলগ্ন পাহাড় ও টিলাগুলি একের পর এক জবর দখল করে নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করতে দেখা গেছে। জবর দখলকারীরা শত শত রোহিঙ্গা মজুর দিয়ে সরকারের নিষেধ উপেক্ষা করে পাহাড় ও টিলা বুলডুজার দিয়ে প্রকাশ্যে কেটে সাবাড় করে নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করতে দেখা গেছে। কেউ অফিস, গুদাম, ল্যাট্রিন, সেড, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র, মেডিকেল সেন্টার, স্কুল, মসজিদ কিছুনা কিছু তৈরি করছে বন বিভাগের পাহাড় কেটে। জবর দখলকারী ও পাহাড় কাটাদের মধ্যে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশন, বেসরকারি সংস্থ্য সেভ দ্যা চিলড্রেন, অক্সফাম, কারিতাস, মুক্তি, এমএসএফ, ব্র্যাক সহ অসংখ্য এনজিও।

উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া গ্রামের আব্দুল গফুর (৫৫), মধুর ছড়া ছৈয়দ নুর (৪৫), আব্দুল লতিফ (৫০) সহ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন অভিযোগ করে জানান, এনজিও–রোহিঙ্গারা যে অবস্থা শুরু করেছে হয়ত এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ স্থানীয় লোকজন অতীব প্রয়োজনে কোন গাছ বা একটু টিলা কাটলে বন বিভাগের দৌড় শুরু হয়। আর হাজার হাজার একর পাহাড় ও লক্ষ লক্ষ গাছ যারা কাটছে তাদের কিছুই হচ্ছে না। বরং এখনো স্থানীয়দের নানা ভাবে নাজেহাল ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন এনজিওগুলো সেবার নামে যা করছে তা স্থানীয় এলাকা ও দেশের জন্য অমঙ্গলজনক। এখানে এসব না করে রাখাইনে গিয়ে যদি তারা এর সিকি ভাগ রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করত তাহলে এ সমস্য এত দূর গড়াতো না। এরা যদি স্থানীয়দের স্বার্থ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তার ফল ভাল হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারী জানান। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু, সেবা সংস্থ্যগুলোর সৃষ্ট অহরহ মানব বর্জ্য, নানা জটিল রোগ ব্যাধি প্রভৃতির কারণে স্থানীয় লোকজন এমনিতে জীবন নিয়ে চরম হুমকিতে রয়েছে। যেভাবে পাহাড় ও টিলা গুলো সাবাড় করা হচ্ছে এ ক্ষতি কোনদিন পূরণ হবে না। তাই ওদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি সহ স্থানীয় লোকজন।

উখিয়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, গত অর্থবছরের উখিয়া বন রেঞ্জ কর্তৃক ১৩৮ কোটি টাকার বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছে। তা ছাড়া রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণকালে সৃজিত বন বাগান উজাড় করা হয়েছে ১৮শ ৫০ একর। এসব বন বাগানে বিভিন্ন মেয়াদি গাছ ছিল প্রায় ১৮ লক্ষ ৫০ হাজারটি। এছাড়াও কুতুপালং ও বালুখালী–১ ও ২, তাজনিমার খোলা, ময়নার ঘোনা, জামতলী, শফিউল্লাহ কাটা ও হাকিম পাড়া, উখিয়া সদর, উখিয়ার ঘাট ও থাইংখালী বন বিটের আওতায় এসব রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে বন ভূমি ধ্বংস করা হয়েছে ৪হাজার ৮শ একরের মত।

তিনি বলেন, বনায়ন সৃষ্টি করে গাছ না হয় তোলা যাবে, কিন্তু বন ভূমির পাহাড় ও টিলা কেটে যেভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে তার ক্ষতি মিটানো যাবে ! এ পর্যন্ত বনায়নে শুধুমাত্র গাছ কাটার ক্ষতি হয়েছে ৪শ কোটি কাটা বেশি। তিনি বলেন, এসব বনাঞ্চল ছিল হাতিসহ অসংখ্য বন্য প্রাণী জীব বৈচিত্রের আবাস ও বিচরণস্থল। বর্তমানে সেরকম কোন পরিবেশ বা সুবিধা না থাকায় এগুলো বিলুপ্তের পথে। উল্লেখিত বনাঞ্চলে সবই সরকারি রিজার্ভ ভূমি। স্বল্প সংখ্যক বন কর্মীর বাধা কেউ না মানায় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নানা অজুহাত দেওয়ায় বন বিভাগ এক প্রকার অসহায়ের মত থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

পাঠকের মতামত: